বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল এক মহান ইতিহাস, যা শোষণ, নিপীড়ন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক যুগান্তকারী প্রতিরোধ ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার পরেও অনেক ক্ষেত্রে দেশবাসী আবারো পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। “স্বাধীনতার মোড়কে পরাধীনতার শৃংখল” এমন একটি ভাবনা, যা স্বাধীনতা অর্জনের পরও আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার অগ্রগতি বা অবক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। একদিকে যেমন স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে স্বাধিকার অর্জন হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে সেই স্বাধীনতা অনেক সময় রাজনৈতিক অপশাসন, দারিদ্র্য, সামাজিক অবিচার ও অন্যায়ের শৃঙ্খলে রূপান্তরিত হয়েছে।
স্বাধীনতার মোড়কে পরাধীনতার শৃংখলের প্রথম প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক অস্পষ্টতা এবং নেতৃত্বের দুর্বলতা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতারা ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম করলেও, তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল না। একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভক্তি, এক দলীয় শাসনব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে একধরনের রাজনৈতিক পরাধীনতার মধ্যে আটকে রাখা হয়। জনগণের প্রকৃত স্বার্থরক্ষা করতে ব্যর্থ হলে, এই ধরনের শাসনব্যবস্থা জনগণের জীবনে শৃঙ্খল তৈরি করে দেয়, যেখানে স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ জনগণের উন্নয়ন, সার্বভৌমত্ব ও অধিকার রক্ষা, বিস্মৃত হয়ে যায়।
অন্যদিকে, আমাদের অর্থনীতি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও এক ধরনের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক এবং দারিদ্র্যের সাথে গভীর সম্পর্কিত। স্বাধীনতার পর, অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করার জন্য যথেষ্ট পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, ফলে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নতি লাভ করেনি। গরিবি, কর্মসংস্থানের অভাব, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং বৈদেশিক ঋণের বোঝা জনগণের জন্য শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া, অনেক সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনৈতিক পরাধীনতা এবং বিদেশি শক্তির প্রভাবও দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নেও স্বাধীনতার পর অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা এবং প্রয়োগের অভাব ছিল। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা, স্বাস্থ্যসেবায় অপ্রতুলতা, এবং দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা পৌছানোর সমস্যা এই সকল ক্ষেত্রের উন্নতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও অব্যবহারিতা দেশকে এক ধরনের সামাজিক পরাধীনতার মধ্যে ফেলেছে, যেখানে জনগণের অধিকার এবং সুযোগের সীমাবদ্ধতা বেড়ে গেছে।
এরপর, সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সামাজিক অনিয়ম, যেমন: নারীর প্রতি বৈষম্য, সামাজিক অস্থিরতা,স্বাধীনতার আদর্শের বিপরীতে চলে গেছে। যদিও বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছে, তবুও মুক্তির পরও তারা নানা ধরনের সামাজিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ রয়ে গেছে। সমাজে অগণিত জনগণ এখনো নিরক্ষর, খাদ্য নিরাপত্তাহীন, স্বাস্থ্য সেবার অভাব এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
স্বাধীনতার মোড়কে পরাধীনতার শৃঙ্খল আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে চিহ্নিত করা যায়। যেখানে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও জনগণের জীবনমানের উন্নতি, অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনতার মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও সমানাধিকারভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠবে, কিন্তু নানা কারণে এই আশা এখনো পূর্ণতা পায়নি। এটি আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের দেশের ভবিষ্যত, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব, সামাজিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক শক্তি সবই একসাথে মিলিত হয়ে জাতির জন্য একটি সমৃদ্ধির পথ তৈরি করবে। আমাদের উচিত, সেই পথে কাজ করতে এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হতে, যাতে স্বাধীনতার প্রকৃত শৃঙ্খল মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
Leave a Reply